আমার নির্বাসন - পর্ব ৩: লাইবেরিয়া "The country of the FREE" | ভ্রমণ ব্লগ

আমার নির্বাসন পর্ব-৩: লাইবেরিয়া "The country of the FREE"

লাইবেরিয়ার আকাশপথ থেকে দৃশ্য

স্বাধীন আফ্রিকান

ঘানায় বিমানটা নেমেছিল তেল নেবার জন্যে; তাই আমার আর নামা হল না। অনন্ত জলিল ভাইয়ের কল্যাণে, ঘানা দেশটাকে বেশ দেখার ইচ্ছে তৈরি হয়েছিল। রানা স্যার বললেন, ইউ এন এর বিমানে লাইবেরিয়া থেকে এখানে বেড়াতে আসা যায়। আপাতত তাই ইচ্ছের রাশ টেনে রাখলাম; নির্বাসনের বহুত সময় সামনে, কিছু একটা জিনিস করবার মত রাখা গেল ভবিষ্যতের জন্যে।

আমার পাশের সিটটা খালিই রইল, লাইবেরিয়ান তরুণী এক কোনায়, আর আমি জানালার পাশে। এখান থেকে আরও এক ঘণ্টার পথ। পথ চলতে চলতে আমি ক্লান্ত। পশ্চিমে যাচ্ছি বলে সময়ের আগে চলে আসছি বারবার, দেশ থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম রাত ১০টায়, এখন দেশের সময় পরদিন রাত ৮টা। বিমানটা আকাশে উড়তেই তাই এলিয়ে গেলাম ঘুমে। ঘুম ভাঙ্গল ক্যাপ্টেনের ঘোষণায়, অবশেষে আমরা পৌঁছেছি লাইবেরিয়ার আকাশে।

লাইবেরিয়ার আকাশপথ থেকে দৃশ্য

লাইবেরিয়ার আকাশপথ - সবুজ ও নীলের মেলবন্ধন

আকাশে কাল মেঘ, আমার দেশের বর্ষার মেঘ। মেঘের ভেতর থেকে বিমানটা বের হতেই দেখলাম, আটলান্টিকের তীরে সবুজ একটা ভুখণ্ড। সবুজ আর নীলের অপরূপ কম্বিনেশন। হঠাৎই ভালো লেগে গেল, আমার বন্দিশালা, মুক্তদের দেশ (the country of the free), লাইবেরিয়াকে।

লাইবেরিয়ার আদি ইতিহাস

লাইবেরিয়া পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ যা ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি আফ্রিকার প্রথম প্রজাতন্ত্র এবং সাহারা-নিম্ন আফ্রিকার প্রথম আধুনিক গণতন্ত্র। লাইবেরিয়া আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়, যারা মুক্ত আমেরিকান দাসদের পুনর্বাসনের জন্য এই উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। 'লাইবেরিয়া' নামটি ল্যাটিন শব্দ 'লিবার' থেকে এসেছে যার অর্থ 'মুক্ত'।

বিমানবন্দরে নেমে মনে হল, এ আমি কোথায় চলে আসলাম। কোনভাবেই এটাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফেলা যায় না। ছোট একটা টার্মিনাল বিল্ডিং এ সবাই লাইন দিয়ে ঢুকলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ব্যাগ নিতে আসলাম। বুক ধুকপুক, সেই ঢাকায় শেষ দেখেছিলাম ব্যাগগুলোকে, এতটা রাস্তা আমার সাথে আসতে পেরেছেতো 'বাচ্চা' গুলো? অবশেষে এল তারা, জানি পানি এল, এদের ছাড়া আমি মোটামুটি অচল হয়ে যেতাম এই বিদেশে।

ভ্রমণ টিপ

লাইবেরিয়ার রবার্টস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আফ্রিকার ছোট বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটি। ভ্রমণের সময় অতিরিক্ত ধৈর্য্য ধরুন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত রাখুন।

বাইরে বের হয়ে দেখি, "কুকুর বেড়াল" বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট এতটাই প্রকট যে আমাদের নিতে আসা গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে কাঁক ভেজা হয়ে যেতে হবে। এদের ঋতু দুইটা। মে থেকে অক্টোবর ভেজা মৌসুম, নভেম্বর থেকে এপ্রিল শুকনো মৌসুম। লাইবেরিয়া পৃথিবীর অন্যতম "ভেজা" জায়গা। আমার আগের জন আমাকে এই ব্যাপারে সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন ভাগ্যিস!

মজার তথ্য

লাইবেরিয়ার বার্ষিক বৃষ্টিপাত গড়ে ৪,০০০ মিমি (১৫৭ ইঞ্চি), যা বিশ্বের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের দেশগুলির মধ্যে একটি। উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাত আরও বেশি, বছরে ৫,০০০ মিমি পর্যন্ত হতে পারে।

সবাই যখন না ভিজে গাড়ি পর্যন্ত দৌড়ের জন্যে তৈরি, তখন আমার হাতে ছাতা দেখে রানা স্যার আকর্ণ হাসি দিলেন! "যা বেটা, তুই পাশ!" আমি আগে কখনও ছাতা হাতে এত গর্বিত বোধ করিনি!

"দেশি বিদেশ!"

গাড়ি চলেছে ঘন বৃষ্টির মাঝে, আমার উৎসুক দৃষ্টি রাস্তার দুপাশে, সবুজ আর সবুজ। পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটার আয়তন ৪৩ হাজার বর্গ মাইল। বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি ছোট নয়, কিন্তু আমাদের ১৬ কোটির বিপরীতে এদের আছে মাত্র ৩৭ লাখ লোক! স্বভাবতই রাস্তার আসেপাশে বসতি চোখে পড়ছিল কদাচিৎ।

লাইবেরিয়ার আকাশপথ থেকে দৃশ্য

সোজা পথ আর সবুজপ্রান্তর

নাম না জানা বেশ কিছু গাছের মাঝে হঠাৎ আম গাছ দেখে প্রায় আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। আমাদের নিতে আসা কর্নেল সাদিক স্যার বললেন, "কত আম খাইবা! এদের এইখানে আম, আমড়া, আনারস, কমলা, কলা অফুরন্ত! সবচেয়ে বড় কথা, ফরমালিন জিনিসটা এরা এখনও চেনে নাই!"

মনে কিছুটা শান্তি অনুভব করলাম, যাক বাবা, কিছু না হলেও অন্তত ফল খেয়ে বাঁচতে পারব। আমার মেয়েটার জন্যে মায়া হল, বেচারার ফল খুব পছন্দ! কিন্তু আমাদের দেশের নির্দয় ব্যবসায়িরা আমার মেয়েকে বঞ্চিত করছে সে আনন্দ থেকে। জেনেশুনে কে বিষ খাওয়াবে সন্তানকে? আমার মনে হয়, আমার দেশের ফল ব্যবসায়িদের কোন সন্তান নেই; সেটাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়!

মজার তথ্য

লাইবেরিয়ার জলবায়ু ক্রান্তীয় প্রকৃতির হওয়ায় সারা বছর প্রচুর ফল উৎপন্ন হয়। দেশটিতে প্রায় ২০০ প্রকারের স্থানীয় ফল পাওয়া যায় যার মধ্যে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিচিত।

আবহাওয়া যেমন মনে হচ্ছে, তাতে চিটাগাংয়ের সাথে খুব বেশি পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আনমনা হয়ে গেলাম! অবশেষে আসলাম আমার বন্দিশালার সামনে, যেখানে একবছর কাটাতে হবে।

B-First; একটা বাংলা রেস্টুরেন্ট। ম্যানেজারের নাম আরশ আলী। বাংলা শান্তিরক্ষীদের জন্যে থাকার ব্যবস্থাও করেন। বি-ফার্স্ট রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলায় আমার নিবাস, বি মানে বাংলাদেশ, বিদেশে আমার দেশ! মনটা ভালো হয়ে গেল হঠাৎ করেই। আমাকে রুমে নিয়ে গেলেন মেজর সাব্বির স্যার, উনার সাথেই থাকব। রুমটা আমার কল্পনার তুলনায় অনেক গুণে ভালো।

ফ্রেশ হবার জন্যে বাথরুমে ঢুকতেই, নিচের রেস্টুরেন্টের গানের আওয়াজ ভেসে এল, "ও আমার দেশের মাটি, তোমার পড়ে ঠেকাই মাথা..." চোখটা একটু ভিজে উঠল কি!

"বিদেশে আমার দেশ! মনটা ভালো হয়ে গেল হঠাৎ করেই।"

- লেখক

চলবে...

Scroll to Top