উঠোন পেরিয়ে আফ্রিকা - পর্ব ৩: লোকালয় ছেড়ে বনে | লেক ম্যানিয়ারা ন্যাশনাল পার্ক
পর্ব ৩

।।।।। উঠোন পেরিয়ে আফ্রিকা ।।।।।

লোকালয় ছেড়ে বনে - লেক ম্যানিয়ারা ন্যাশনাল পার্ক

#তানজানিয়ার_দিনরাত্রি #ভ্রমণকাহিনী

গাছে চড়া সিংহের প্রথম দেখা

দুটো সিংহী গাছের মগডালে বসেছিল, কিছুক্ষণের জন্য একজন দাঁড়ালো, আবার বসে পড়লো। চারিদিকে আরো অনেক সাফারি গাড়ি, ক্লিক ক্লিক শব্দে আমার দিশেহারা অবস্থা। এরকম খোলা জায়গায় সিংহ দেখিনি তো আগে। কোন কারণে একজনের যদি এদিকে দৃষ্টি পড়ে, তাহলে এত গাড়ি, কোনটা কোন দিকে দৌড়াবে? পৃথিবীতে মাত্র দু জায়গাতে গাছে চড়া সিংহ দেখা যায়, তানজানিয়ায় ম্যানিয়ারা ন্যাশনাল পার্ক আর উগান্ডার কুইন এলিজাবেথ ন্যাশনাল পার্কে।

[এখানে গাছে বসে থাকা সিংহের ছবি যোগ করা যেতে পারে]

আমি অবশ্য ভীতু মানুষ, আমার মনে হচ্ছিল দেখা শেষ করে এখান থেকে দ্রুত সরে যাওয়াই তো ভালো। সোহানের অবশ্য তা মনে হচ্ছিল না, সে উঁকিঝুঁকি মারছে, আর বলছে,‘সিংহ একা থাকে না, দলবলসহ থাকে, ওদের দল তাহলে আশেপাশেই আছে, সেটা যদি দেখা যেত!’ আমি ভয়েই আধখানা, আরও সিংহ জঙ্গল থেকে বের হলে, হৃদপিন্ডে আচমকা আক্রমণ হতে পারে, জীবনে প্রথম বার গেইম ড্রাইভের জন্য দূর থেকে গাছে বসা সিংহ দেখাই আমার জন্য যথেষ্ট!

ম্যানিয়ারা যাত্রা: শহর থেকে জঙ্গলের পথে

সেদিন সেবন্তির অনলাইন স্কুল ছুটি ছিল। সোহান আগেরদিন থেকেই বলে রেখেছে আমরা সকাল সকাল বের হয়ে যাবো। সকাল সকাল বের হবো বললেও সবকিছু ঠিকঠাক করে, নিজেরা চা-নাস্তা খেয়ে, বাচ্চাদের মুখে কিছু একটা দিয়ে, দরজা-জানালা ঠিক মতো বন্ধ করে রাস্তায় নামতে নামতে সাড়ে নয়টা বেজে যায়। আমাদের এবারের গন্তব্য হলো ম্যানিয়ারা ন্যাশনাল পার্ক। আফ্রিকার ন্যাশনাল পার্কগুলো সম্পর্কে তখন পর্যন্ত আমার জ্ঞান ‘মাদাগাস্কার’ এনিমেশন মুভি পর্যন্তই। তাই এই পার্কে ঘুরার সময় আমার এই মুভির চরিত্র আর দৃশ্যগুলো বারবার চোখে ভাসছিল।

তানজানিয়ার রাস্তা: বাংলাদেশ থেকে একদম ভিন্ন অভিজ্ঞতা

আরুশা থেকে ম্যানিয়ারা পশ্চিমের দিকে, এর আগের সপ্তাহে আমরা মোসি শহরে গিয়েছিলাম। মোসি শহর ম্যানিয়ারা শহর থেকে বেশী ব্যস্ত শহর, তাই সেদিন মোসিতে যাওয়ার সময় রাস্তায় যতটুকু গাড়ি দেখেছিলাম আজ তার থেকেও কম গাড়ি দেখছি। বাংলাদেশের রাস্তায় অভ্যস্ত কেউ তানজানিয়ার রাস্তায় গিয়ে ভাববে অন্য জগতে চলে আসছি।

যাত্রার শুরুতে কিছু বাড়ি, দোকান-পাট দেখা যায়, আস্তে আস্তে সেটাও কমে যায়। রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ন খোলা মাঠ, এখানে সেখানে খোলা মাঠে ঝোপের মতো দেখতে গাছ , পরে জেনেছি এই গাছের নাম একাশিয়া। মাঠের শেষে ঢেউ খেলানো পাহাড় কালচে আকাশী নীল রঙ হয়ে আকাশের সাথে মিশে গিয়েছে। এরকম ধূ ধূ প্রান্তরে এসে মনে হয়, কোথাকার মানুষ আমরা, কোথায় এসে পড়লাম। রাস্তায় মাঝে মাঝে একজন দুজন মাসাইয়ের লাঠি হাতে হেঁটে যাওয়া দেখছিলাম। এক মাসাইয়ের এক পাল ছাগল নিয়ে রাস্তা পাড় হওয়ার সময় আমরা গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করি। খোলা প্রান্তরে মাসাইদের গ্রামও দেখলাম। একাশিয়া গাছ দিয়ে চারদিকে বেড়া দেওয়া, মাঝখানে তাদের ঘরগুলো। এই এলাকায় মানুষ এত কম, বন্য প্রানীরাও এখানে ঘোরাফেরা করে। ম্যানিয়ারা শহরে পৌছানোর আগেই রাস্তায় হাতি দেখে ফেলেছি। হরিণও রয়েছে, যদিও হরিণ দেখেছি ফেরার পথে।

[এখানে তানজানিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি যোগ করা যেতে পারে]

গোরংগোরো ক্রেটার: বিশ্ব ঐতিহ্যের অপূর্ব নিদর্শন

এ শহরে প্রবেশের অনেক আগে থেকে আপনি প্রকৃতির এক অপূর্ব নির্দশন দেখবেন, আর সেইটা হলো পৃথিবীর সচেয়ে বড় ভল্কানिक ক্রেটার গোরংগোরোর পাহাড়ের বাউন্ডারী। আড়াই হাজার বছর আগে কিলিমাঞ্জারো থেকেও বিশাল বড় পর্বত অগ্নুৎপাতের কারনে মাঝখান থেকে দেবে গিয়ে এই ক্রেটারের উৎপত্তি। এই ক্রেটার ঢাকা শহরের প্রায় সমান। এখানে মাসাইরা বন্যপ্রাণীদের সাথে একসাথে বসবাস করে। এটা সংরক্ষিত এলাকা এবং ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মধ্যে একটি। আমাদের ভ্রমণ তালিকায় গোরংগোরো ক্রেটারও আছে, তাই এটা নিয়েও ইনশাআল্লাহ একটা পর্ব হবে। আপাতত লেক ম্যানিয়ারা ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে আসি।

[এখানে গোরংগোরো ক্রেটারের একটি প্যানোরামিক ছবি বা ভিডিও যোগ করা যেতে পারে]

পার্কে প্রবেশ: প্রথম জঙ্গল অভিজ্ঞতা

পার্কের টিকেট কাউন্টারের ভদ্রলোক সোহানের সাথে মাস্ক ছাড়া কথা বলবে না। সোহান ফিরে এসে গাড়ি থেকে মাস্ক নিয়ে গেলো। তানজানিয়াতে কোথাও করোনার তেমন কোন প্রভাব দেখা যায় না। আমি ভাবলাম এই এলাকায় লোকজন মনে হয় সচেতন। নিজে আর মেয়েদের মাস্ক পড়িয়ে কাউন্টারে এসে দেখি ব্যাটা নিজেই তো মাস্ক পরে নাই। আমাদের একবছরের থাকার পারমিট কার্ড আছে বলে কিছু কমে টিকেট কাটা গেল। তাও ১১৭ ডলার লেগেছে ভিতরে প্রবেশের জন্য। আমরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে যাবো, গাইড নিতে চাইলে বললো গাইড লাগবে না, আমরা নিজেরাই ঘুরতে পারবো সমস্যা হবে না।

ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার সাথে সাথে মনে হলো বিশাল এক জঙ্গল চোখের সামনে চলে এসেছে। প্রথমবার এমন পার্কে এসে কিছুটা ভয় লাগছিল, কোন অঘটন ঘটবে না তো!! পার্কে ঢুকে ডান পাশে রয়েছে ক্যানোপি ওয়াকের আহবান। এক গাছ থেকে দূরে আরেকটা গাছে বাঁধা দড়ির সাঁকো, এই সাঁকোতে হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের পশু পাখি দেখা যাবে। কিন্তু প্রত্যেকের লাগবে ৫৪ ডলার তাই সেদিকে না গিয়ে সামনে এগুতে থাকলাম।

বন্য প্রাণীর সন্ধানে: হাতি, জিরাফ ও জেব্রা

আমরা অনেকগুলো স্পটে হাতি দেখেছি। এর মাঝে একটা হাতির কান্ড কারখানায় মেয়েরা সাথে তাদের বাবা বেশি মজা পেয়েছে। হাতি তার মাথা দিয়ে গাছ ঝাঁকিয়ে নিল, কি যেন নিচে পড়লো, শূর দিয়ে তুলে তা খেয়ে ফেললো। আরেকটা হাতি অনেকক্ষণ ধরে সাফারি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছিল, টুরিস্টরা তার ছবি তুললো, যখন হাতির মনে হলো অনেক পোজ দিয়েছে, এখন যাই, তখন সে রাস্তা পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল।

[এখানে হাতির ছবি যোগ করা যেতে পারে]

লেকের পাশে একটা বাফেলো উদভ্রান্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, পাশেই একটা মদনটাক পাখি। তাদের থেকে একটু দূরে অজস্র মদনটাক পাখি দাঁড়িয়ে। লেক বরাবরই সোহান এগুচ্ছে হিপো দেখার আশায়। দেখা পাওয়া গেল না কিন্তু দেখা পাওয়া গেল মাদাগাস্কারের কিং জুলিয়ানকে। অনেক কিং জুলিয়ান যার আসল নাম লেমুর। তারা এত ছটফটে ছবি তোলা গেল না। তুলতে পারলেও বোঝা যেত না, কারণ তারা পুরোই মাটির সাথে ক্যামোফ্লজ হয়ে ছিল।

"গাড়ি শুধু কানা গলিতে গিয়ে থামে। গাড়ি ঘুরিয়ে সামনে যাওয়ার অল্প কিছুদূর পরই দেখা গেল দুইটা সাফারি গাড়ি দাঁড়ানো, তারমানে কিছু একটা পেয়েছে। 'ও মা জিরাফ' তাড়াতাড়ি সোহান গাড়ি অন্য সাফারি গাড়িগুলোর পাশে রাখলো।"

সাফারি গাড়ি থেকে ইশারা করলো গাড়ি বেশি এগুতে না। মেয়েরাও খুব উত্তেজিত জিরাফ দেখতে পেয়ে। জঙ্গলের পাশে একটু খোলা মত জায়গা, সেখানেই সে বড় গাছের পাতা খাচ্ছে আর আমাদের দেখছে। মনে হলো আমরা জিরাফের বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে, জিরাফ এই অনাহুত অতিথি নিয়ে কি করবে বুঝতে পারছে না। অন্য সাফারি গাড়িগুলো চলে গেল। সোহান গাড়ি একটু আগালো, সাথে সাথে সেবন্তি চিৎকার'বাবা সামনে গাড়ি নিও না।' বাবা বলে, 'আমি গাড়ি ঘুরাবো, চিৎকার করিস না।' আমাদের গাড়ির নড়াচড়াতে জিরাফ দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে গেলো। মেয়ের তো বাবার উপর খুব রাগ। গাড়ি আরেকটু সামনে এগিয়ে ঘুরানোর সময় দেখা গেল, ওখানে আরো একটা জিরাফ ছিল।

[এখানে জিরাফের একটি ভিডিও ক্লিপ যোগ করা যেতে পারে]

হট স্প্রিং এর সন্ধানে

আবার হট স্প্রিং খুঁজে ফিরছি। একজন গাইড থাকলে হয়তো আরো গুছানো হতো ঘুরাঘুরি। হঠাৎ মেঠো রাস্তায় এক সুন্দরী জিরাফকে হেলেদুলে হাঁটতে দেখলাম। সোহান দ্রুত গাড়ি এগিয়ে নিতে নিতে সে জঙ্গলে ঢুকে পড়লো; জঙ্গলে ঢুকলেও তারও আগ্রহ হলো আমাদেরকে দেখার, গাছের আড়ালে এমনভাবে মাথা আঁকাবাঁকা করে আমাদের দেখছিল, সেই উৎসুক মুখ-চোখ আমাদের এখনো মনে ভাসে।

পথ নির্দেশিকা দেখে গাড়ি চলতে চলতে মাঝে মাঝে এমন জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামে, সেখানে সামনে আর রাস্তা নেই। রাস্তা শেষ হয়েছে পানি ছাড়া নদীতে। নদীর ঐ পাড়ে আবার রাস্তা। বর্ষার সময় হয়তো পানি থাকে নদীতে। শুকনো মৌসুমে হয়তো এখান দিয়েই গাড়ি চালানো যায়, কিন্তু আমরা দেখলাম মাটি নরম, এর উপর দিয়ে গাড়ি চালানো যাবে না, গাড়ি ঘুরাতে হবে।

জেব্রা দেখা: মাদাগাস্কার সিনেমার মতো অভিজ্ঞতা

রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক জেব্রা পেলাম। আমাদের দেখে পালিয়ে গেলো না। সুন্দর পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমাদের তো মাদাগাস্কারের মার্টির কথা মনে পড়লো। আমরা যেন আলেক্সের মত মার্টির পেছনের সাদা কালো দাগ চেক করছি। দুটো জেব্রার এই স্ট্রাইপ নাকি কখনোই এক রকম হয় না, সব জেব্রা দেখতে নাকি ইউনিক।

সবুজের মাঝে মেঠো পথের শেষ সীমানায় বিশাল পাহাড়, এই পাহাড়ের উপরের রাস্তা দিয়ে গোরংগোরা যাওয়া যায়, আমরাই যেন এই বনের একমাত্র সাফারি; এত ভালো লাগছিল। রাস্তা আবার দু ভাগ হয়ে আরো সরু হয়ে গেলো। কোন দিকে যাবো বোঝার জন্য সোহান গাড়ি থামিয়ে এক দিকে গেল খোঁজ নিতে। বড় মেয়ে আর আমি দুজনেই ভয়ে আছি সোহানের জন্য, কারণ কখন কোন প্রাণী আবার সামনে এসে পড়ে। সোহান গাড়িতে ফিরে এসে বললো, 'এদিকেই হবে, ঝর্ণার শব্দ পাওয়া যায়।'

হট স্প্রিং: প্রকৃতির উষ্ণ প্রস্রবণ

ওই রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে কিছুদূর এগুতেই আরেকটা গাড়ি দেখলাম। সেই গাড়ির পাশে পার্ক করে রাখলো সোহান। তার বামপাশেই গাছপালার মাঝখানে তাবু খাটানো। তারমানে এইটা হলো একটা ক্যাম্প সাইট। জঙ্গলে যদি কেউ রাত কাটাতে চায় এখানে থাকতে পারবে, প্রাইভেট প্রপার্টি। সোহান পাশের গাড়ির ড্রাইভারের সাথে কথা বলছে, আমি গাড়ি ছেড়ে ঝর্ণার দিকে এগিয়ে গেলাম। ঝর্ণার শব্দে একটা মোহচ্ছন্ন ভাব আছে, কাছে টানতে থাকে। পাহাড়ের পাদদেশে বড় বড় পাথরের মাঝখান দিয়ে পানি ছুটে বের হচ্ছে।

সোহান এসে জানলো, এটা হট স্প্রিং না, আমরা ভুল জায়গায় চলে এসেছি। আমি বলি সমস্যা নাই, তুমি ক্যাম্প সাইটে গিয়ে দেখ কোন খাবার দাবার পাওয়া যায় কিনা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল কোন খাবার নাই। আমার মেয়েদের জন্য খারাপ লাগছিল, সকালেও ঠিক মতো খাওয়ানো হয় নাই। গাড়ি ঘুরিয়ে ওখান থেকে যখন বের হলাম তখন চারটা বেজে গিয়েছে। যাত্রার শুরুতে সোহান বলেছিল, চারটার পর আমরা আবার ফিরে যেতে শুরু করবো। সে জানতে চাইলো, কি করবো এখন ফিরে যাবো নাকি হট স্প্রিং খুঁজবো?? আমার কাছে তো মনে হচ্ছিল দেখে যাই। হয়তো তেমন কিছু না, ওখানে পৌঁছালে হয়তো অনেক হতাশ হবো কিন্তু না দেখলে মনের মধ্যে খচখচ করতেই থাকবে।

হট স্প্রিংয়েই যাবো ঠিক হলো। ডানপাশের পাহাড় আস্তে আস্তে আরো কাছে চলে আসলো। আর বামপাশে তো লেক আছেই। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা পেরিয়ে গেছে। আর অল্প রাস্তা আছে, এমন ভাবতে ভাবতে আমরা এগুচ্ছি। অবশেষে হট স্প্রিং বামে দেখাচ্ছে এমন পথ নির্দেশনা পেলাম। বামে দেখলাম বাধাঁনো সিঁড়ি। মেয়েরা নেতিয়ে গেছে তারা আর নামবে না। বাঁধানো পিলারে লেখা হট স্প্রিং এর কার্যকারণ। সিঁড়ি বেয়ে সোহান প্রথমে নেমে গেল, একটা পঁচা গন্ধ, হাইড্রোজেন সাল ফাইডের। পাহাড়ের ফাটল বেয়ে অল্প অল্প পানি বের হয়ে লেকের পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। সোহান পানি ধরে, সাথে সাথেই সরিয়ে ফেললো হাত। অনেক গরম। পানি যেখান থেকে বের হচ্ছে সেখানে অনেক ধোঁয়া। ফুটন্ত পানি পাহাড়ের ফাটল দিয়ে বের হচ্ছে।

[এখানে হট স্প্রিং এর ছবি যোগ করা যেতে পারে]
"সোহান বলে গরম পানি দেখে আমার প্রথমে কি মনে হইছে জানো, এখানে গরম পানি ফ্রি ফ্রি বের হচ্ছে, আর বাসায় কত ইলেক্ট্রিসিটি খরচ করে গিজারের পানি গরম করা লাগতেছে আমাদের।"

আরুশায় অনেক ঠান্ডা। আর ইলেক্ট্রিসিটি খরচ অনেক বেশি। শুধু মাত্র সন্ধ্যায় হিসাব করে লাইট জালিয়ে আর হিসাব করে গিজারে পানি গরম করে এক মাসে চার হাজার টাকা ইলেক্ট্রিসিটি বিল দিয়ে দিয়েছি। আরও একটা গ্রুপ চলে এসেছে হট স্প্রিং দেখতে। স্থানীয় টুরিস্ট ওরা, আমাদের কাছে জানতে চাইলো ট্রি ক্লাইম্বিং লায়ন দেখেছি কিনা, কোথায় দেখেছি। সোহান তাদের বুঝিয়ে বললো কোথায় দেখেছে।

ফেরার পথ: সন্ধ্যার জঙ্গলে জীবজন্তু

লেকসহ ম্যানিয়ারা ন্যাশনাল পার্কের আয়তন ৩২৫ বর্গকিলোমিটার, এর মাঝে শুধু লেকের আয়তনই ২৩০ বর্গ কিলোমিটার। এত বিশাল লেক; লেক আর আকাশ এক হয়ে হট স্প্রিংয়ের সামনে সত্যি অভাবনীয় এক দৃশ্যের মাঝে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছু সময়। ফিরে যাওয়ার তাড়ার জন্যই আমরা ফিরে যাচ্ছি, নয়তো সেখানে এক বর্ষ দাঁড়িয়ে থাকলেও ক্লান্ত হওয়ার কথা না।

এবার আমরা ফিরে যাবো, যতটা পথ এসেছি, ততটা পথ ফিরে যাবো। কিন্তু মজার বিষয় হলো আমরা ফিরে যাবার সময় বেশি পশুপাখি দেখেছি। তাই ফিরে যাওয়ার পথটা বেশি আনন্দদায়ক ছিল। বিকাল হতে হতে রোদের তেজ কমে গেছে, সাফারি গাড়ির সংখ্যা কমে গেছে, পশু পাখিগুলোও আড়াল থেকে বের হয়ে রাস্তায় চলে আসছিল। আমরা মাঠে জেব্রা ঘুরে বেড়ানো দেখেছি, লেকের কাছে জিরাফদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, অনেক প্রজাতির হরিণ দেখেছি, যার মাঝে রয়েছে ক্রিপ্সপিংগার, কালো হরিণ, ইম্পালা তো আছেই, দেখেছি দাঁতাল শুয়োর, নানা প্রজাতির বেবুন আর বানর। কোনটা বাদামী, কোনটা সাদা কালো, কোনটার পেছনে নীল কোনটার লাল, আরো দেখেছি নানা রংয়ের পাখি।

[এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর একটি গ্যালারি যোগ করা যেতে পারে]

একটা রাস্তায় দেখেছি বেবুনের বিশাল জমায়েত। মনে হলো তারা বৈকালিক সভা করছে। শয়ে শয়ে বেবুন আমাদের গাড়ি পাশ কাটিয়ে গেলো। বিকালে জঙ্গলের সৌন্দর্য যেন কয়েক গুন বেড়ে গিয়েছে।

বের হয়ে যাবার আগ মুহূর্তে আবার দেখেছি ট্রি ক্লাইম্বিং লায়ন। এবারের লায়ন আগের বারের চেয়েও বড়। আমাদের পর যারা হট স্প্রিং দেখতে এসেছিল, তাদের গাড়িও দেখলাম দাঁড়িয়ে সিংহ দেখছে। যাক তারা দেখতে পারছে দেখে আমরাও খুশি হলাম।

বেবুনের সাথে আইসক্রিম অভিজ্ঞতা

পার্ক থেকে বের হতে আমাদের দেড় ঘন্টার উপরে লেগেছে। মেয়েরা কিছু খেতে চায়, খাবারের দোকান খুঁজে বের করে, এদেরকে খাবার দিতে দিতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। পার্কের গেটের সাথেই দেখলাম আইসক্রীমের দোকান, আমি দুই মেয়েকে নিয়ে গেলাম আইসক্রিম কিনে দিতে, আর সোহান গেলো নামায পড়তে। চারজনের জন্য চারটা আইসক্রিম কিনে বের হবো, দেখি, একখান বড়সড় বেবুন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অপেক্ষায়, আইসক্রীমে হামলা চালানোর ইচ্ছা নিয়ে। আমি আবার দোকানের ভেতরে ঢুকে, ওখানকার একজনকে দেখালাম। সে বের হয়ে তাকে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিল। আমি ঝটপট দুই মেয়ে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। ওখানে চারদিকে আরো অনেকগুলো বেবুন ছিল। সোহান বলল তোমরা ঢুকার পর থেকে বেবুনটা সেখানে অপেক্ষায় ছিল।

[এখানে বেবুনের ছবি যোগ করা যেতে পারে]

ফেরার পথের ভাবনা

ম্যানিয়ারা ন্যাশনাল পার্কের এই গেইম ড্রাইভ আমাদের জন্য প্রথম, তাই সবসময় এই পার্ক আমাদের জন্য খুবই জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে। প্রথমবার আমরা জঙ্গলে অনাহুতদের মত ঘুরিয়ে বেড়িয়েছে, পাহাড়-জঙ্গল-জল আর পশু-পাখির সাথে মাখামাখি এই দেখা-সাক্ষাতের সময় মনে হয়েছে লক্ষ বছর আগে মানুষ নামের প্রাণীও তো এদের দলে ছিল, তখন কি অন্য কোন প্রাণ তাদের পর্যবেক্ষণ করেছে অন্য কোন বাহনের আড়ালে।

লেক ম্যানিয়ারা ন্যাশনাল পার্ক ভ্রমণ টিপস:

  • সকাল সকাল পার্কে প্রবেশ করুন যাতে বেশি প্রাণী দেখতে পান
  • গাইড নেওয়া ভালো, বিশেষ করে প্রথমবারের visitorsদের জন্য
  • খাবার ও পানি সঙ্গে নিয়ে যান, পার্কের ভিতরে খাবারের ব্যবস্থা খুব সীমিত
  • টেলিফোটো লেন্স সঙ্গে নিন ভালো ছবি তোলার জন্য
  • বিকেলের দিকে ফেরার সময় বেশি প্রাণী দেখা যায়
Scroll to Top