উঠোন পেরিয়ে আফ্রিকা - পর্ব ২: অধরা ম্যাটেরুনি | তানজানিয়া ভ্রমণ
পর্ব ২

।।।। উঠোন পেরিয়ে আফ্রিকা ।।।।

অধরা ম্যাটেরুনি - কিলিমাঞ্জারোর পাদদেশে ঝর্ণার সন্ধানে

#তানজানিয়ার_দিনরাত্রি #ভ্রমণকাহিনী #ম্যাটেরুনি_ঝর্ণা #কিলিমাঞ্জারো

তানজানিয়া আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ আর সৌন্দর্যে ভরপুর বিশাল একটি দেশ। কিলিমাঞ্জারো আর মাউন্ট মেরু আফ্রিকার বিশালতম এই দুই পর্বত মাত্র ৬৮ কি.মি দূরত্বে তানজানিয়ার ভৌগলিক সীমানার মাঝে রয়েছে। আমরা মাউন্ট মেরুর শহর আরুশায় ১১ মাস কাটানোর একটা সুযোগ পেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। আমার কাছে আফ্রিকা মনে হয়েছে মানুষের ডিজিটাল উন্নতির স্পর্শবিহীন বিশুদ্ধ প্রকৃতি, যেখানে লম্বা একটা শ্বাস নেওয়া যায়। কিন্তু এখানে এসেও সোহান এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সারাদিন একা একা সময়ই বেশি কাটাতে হয়। আর অপেক্ষা করতে থাকি সোহান কবে বাসায় থাকবে, দূরে কোথাও কবে যেতে পারবো।

তানজানিয়া সম্পর্কে

তানজানিয়া পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ যেখানে আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত কিলিমাঞ্জারো অবস্থিত। দেশটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জাতীয় উদ্যান এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। আরুশা শহরটি মাউন্ট মেরুর পাদদেশে অবস্থিত এবং অনেক সাফারির প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে।

তানজানিয়ায় আসার পর প্রায় প্রতিদিনই আমি রাত চারটা/ সাড়ে চারটার পর থেকে জেগে থাকি। সোহান অফিস যায় সাড়ে ছয়টায় আবার সেবন্তির অনলাইন ক্লাসও সাড়ে ছয়টায়। বাংলাদেশের সাথে তানজানিয়ার সময়ের পার্থক্য ৩ ঘন্টা। সে হিসাবে ওখানে ক্লাশ শুরু হয় সাড়ে ৯টায় আর এখানে আমার মেয়ে ক্লাশে বসে সাড়ে ৬টায়। সেদিন রবিবার সোহানের অফিস না থাকলেও সেবন্তির স্কুল ছিল, তার ক্লাস টেস্ট চলছে। মেয়েকে স্কুলে বসানোর সময় মনে হচ্ছিল মাথা ব্যথা শুরু হবে আজকে। আমার মাইগ্রেনের সমস্যা আছে, আজকে রবিবার এটাকে আমি কোন ভাবেই বাড়তে দিতে চাই না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলে হয়তো বাড়বে না, তাই আমি রেস্ট নিতে চাচ্ছিলাম কিছুক্ষণ। সাড়ে সাতটার দিকে দুধওয়ালা আসে, তাকে বিদায় করে আবার বিছানায় মাথা লাগালাম। এর মাঝে সেবন্তির ডাক, 'মা… মা'। তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আমার ফোন লাগবে ছবি তুলে পাঠাবে। এসব করে ফ্রেশ একটা ঘুম কখনোই দিতে পারি না। আমি জানি বেশির ভাগ মায়েদেরই একই অবস্থা।

যাত্রা প্রস্তুতি: মাথাব্যথা সত্ত্বেও

সোহান ভোরে নামাজ পড়ার পর ঘুমিয়ে সাড়ে নয়টার দিকে উঠলো, ঘুম থেকে উঠেই, "চল যাই, যাবা না", তাড়া দেওয়া শুরু করলো। তাকে জানালাম আমাকে যদি ১০ মিনিট চোখ বন্ধ করার সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে আমি কোথাও যেতে পারবো না। ছোট মেয়ে এখনো নাস্তা করেনি। সে আর ছোট মেয়ে যেন নিজ দায়িত্বে নাস্তা করে নেয়। "কোন সমস্যা নাই, আমি সব সামলিয়ে নিচ্ছি" বিশাল একটা ভাব নিয়ে আমাকে পাঠালো, একটা ন্যাপ নেওয়ার জন্য। ন্যাপ নিতে আসলেও কান ছিল রান্নাঘরে। তাদের ধুপধাপ শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে না পেরে, উঠে এসে তাদের কর্মকান্ড দেখতে লাগলাম। আমি গিয়ে দেখি, তারা রেস্টুরেন্ট রেস্টুরেন্ট খেলছে। প্লেটে একটা রুটি আর ডিম ভাজি করে দেওয়া হয়েছে। রেস্টুরেন্ট স্টাইলে অবন্তিকে চেয়ার টেনে বসতে দেওয়া হলো। বাবার কাজকর্মে খুব খুশি হয়ে, হাসি হাসি মুখে সে চেয়ারে বসলো। এখনো খাওয়া শুরু করেনি। আমি জানি, শেষ পর্যন্ত আমি নড়াচড়া না করলে বের হওয়া হবে না। সোহান কিছু থালাবাটি ধুয়েছে, বাকিগুলো আমি ধুয়ে, দু'কাপ চায়ের পানি বসালাম চুলায়। অবন্তি কখনোই নিজের খাবার নিজে খাবে না, তাই আমিই তাকে খাওয়ানো শুরু করলাম। সোহান আমার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে বোঝার চেষ্টা করছে, আমি আসলে যেতে পারবো কিনা। সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করি আমরা ছুটির দিনে বের হবো, সেখানে মাথাব্যথা বলে বাসায় থাকতে হবে সেটা আমি কোন ভাবেই চাই না।

ভ্রমণের চ্যালেঞ্জ

পরিবার নিয়ে ভ্রমণের সময় প্রায়ই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় - শিশুদের স্কুল, স্বাস্থ্য সমস্যা, সময় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এই পর্বে লেখিকা মাইগ্রেনের সমস্যা সত্ত্বেও ভ্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যা অনেক পরিবারের জন্য পরিচিত একটি অভিজ্ঞতা।

মোসির পথে: আরুশা থেকে যাত্রা

সোহান মোসি শহরের একটা হোটেলের রুম বুক করেছে। হোটেলটার অনলাইন রিভিউ খুবই ভালো। হোটেলের ছাদ থেকে কিলিমাঞ্জারো দেখা যায়। যেহেতু আমার মাথা ব্যথা; আমরা হোটেলে যাবো, রেস্ট করবো, খাওয়া-দাওয়া করে হোটেলের ছাদে বসে কিলিমাঞ্জারো দেখে চলে আসবো। সবকিছু গুছিয়ে রওনা দিতে দিতে ১১ টা বেজে যায়। এই প্রথমবার আমরা আরুশা শহরের বাইরে যাচ্ছি। আমাদের গাড়িতে এখনো স্পেয়ার চাকা লাগানো। সোহানের ভাষ্যমতে এবার সে খুব সাবধানি কারণ যাত্রার শুরুতে সে গাড়ির চাকার প্রেশার চেক করে নিবে। এই রাস্তা দিয়ে সোহান নিয়মিত কলেজে যায়, তাই সে জানে কোথায় যাওয়া লাগবে। প্রেশার চেক করে, পেমেন্ট করে সোহান গাড়িতে বসলো। জানতে চাইলাম, 'কত দিলে?' সে বললো, ৫০০০ শিলিং। ৫০০০ মানে হলো ১৮০ টাকা। আমি বললাম, দেশে তো ২০ টাকাতেই এই কাজ হয়ে যায়। সোহান বলে, 'ব্যাটা তো টাকা নিয়ে আর ফেরত দিল না!' এখানে এসে শিলিং টাকা হিসাব মিলাতে মিলাতেই অনেক শিলিং খরচ হয়ে যায়। পরে মনে হয় এইটা কি হলো, এত টাকা নিল কেন!

"আমাদের দেশের মতো খুব জাক-জমকপূর্ণ কোন শপিংমল বা দোকানপাট নাই। একদম নাই, সেটাও না, কিন্তু বেশিরভাগ দোকানপাট খুব সাধারণ চারকোনা ঘর তুলে বানানো হয়েছে; আমাদের দেশে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে দোকানপাট যেমন।"

আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আরুশা ভয়ানক সুন্দর শহর। মনে হবে মালভুমির উপরে আছি। রাস্তার দুপাশ দিয়ে অনেক খানি ঢালু ভূমি, সেখানে আবার নানারকম গাছ বড় হয়ে রাস্তার উচ্চতা ছাড়িয়ে গিয়েছে;তখন আর বুঝতে পারা যায় না, পাহাড়ের উপরের রাস্তা দিয়ে চলছি। রাস্তার দুপাশে অনেক প্রাচীন গাছ; কোন উঁচু বিল্ডিং নাই, বেশিরভাগ এক/দোতলা বিল্ডিং, উপরে নানারঙের টিনের চাল, দেখতে ভালো লাগে। আমাদের দেশের মতো খুব জাক-জমকপূর্ণ কোন শপিংমল বা দোকানপাট নাই। একদম নাই, সেটাও না, কিন্তু বেশিরভাগ দোকানপাট খুব সাধারণ চারকোনা ঘর তুলে বানানো হয়েছে; আমাদের দেশে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে দোকানপাট যেমন। পলিথিন দিয়ে বানানো দোকানও রয়েছে। অবশ্য কয়দিন পর দেখলাম অস্থায়ী সব দোকান ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, কারন তাদের প্রেসিডেন্ট বলেছে আরুশা টুরিস্ট সিটি, এখানে রাস্তার পাশে এমন দোকান থাকবে না। তারপর থেকে আরুশাতে এমন দোকান পাট কমে গিয়েছে।

Arusha city streets and architecture
আরুশা শহর

হোয়াইট হাউজ হোটেল: কিলিমাঞ্জারোর অপেক্ষা

আমরা আরুশা শহর থেকে বেরিয়ে মোসি শহরে যাওয়ার হাইওয়েতে আছি। বায়ে বা ডানে যেদিকেই তাকাই না কেন, চোখ আটকায় না। মাঝখানে দীর্ঘ সোজা রাস্তা। রাস্তা এত বিস্তৃত দূর সীমানায় রাস্তার ঢেউ খেলানো দেখা যায়। আমার কাছে মনে হয়েছিল, এই রাস্তায় ঘুরোঘুরি করে আবার বাসায় ফেরত যদি চলে যাই, তাও দুঃখ থাকবে না। চোখ ও মন দুটোরই প্রশান্তি মেলে এখানে। আবার এরকম রাস্তায় চললে নিজের দেশের কথা মনে হয়, কত ছোট একটা দেশ আমাদের। আমরা দিগন্তে চোখ মেলতে পারি না, আমাদের শিশুদের খেলার মাঠ সেই কবে দখল হয়ে গিয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি বুড়ো বয়েসে একটা ১২০০ বর্গফুটের বাসার মালিক হবো!!

মোসি শহরের একটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পার হয়ে, আমরা একটা কাঁচা রাস্তায় চলে আসলাম। এখন একটা গ্রামের পথ দিয়ে চলছি। রবিবার এখানে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা চার্চে যান, বড় সুন্দর একটা চার্চের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় চার্চ ফেরত মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে। গুগল ম্যাপ আমাদের নিয়ে গেল একদম গ্রামের ভেতর। শীত শীত আবহাওয়া বলে দুপুর সাড়ে বারোটার সময় গ্রাম থেকে মোরগের ডাক শোনা যাচ্ছে। অল্প একটু জায়গার উপর চারতলা বিল্ডিং নাম হোয়াইট হাউজ। করোনার জন্য সবার ব্যবসাতেই মন্দা যাচ্ছে। হোটেল একদম খালি মনে হলো। বড় মেয়ে অনেকক্ষণ থেকে ওয়াশরুমে যেতে চায়। গাড়ি থেকে নেমে আমি দুই মেয়ে নিয়ে ওয়াশরুম খুঁজতে বের হলাম। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় প্রথমেই মনে হয়, পানি ব্যবহার করা যাবে তো!! হোটেলের একজন কর্মী, আমাদের হোটেলের পেছনের দিকের একটা পথ দেখিয়ে দিল। ওখানে গিয়ে দেখি হোটেলের রেস্টুরেন্ট সেইটা। একজন ইউরোপীয় কাস্টমার একটা টেবিল দখল করে আছেন। ওয়াশরুম পরিস্কার ছিল, পানিও ছিল। ওখান থেকে আবার সোহানের কাছে রিসিপশনে আসলাম। আমাদের দেখে সোহান বললো, কিছু খাবা?? এই বলে একটা দরজা খুললো, দেখি সেই রেস্টুরেন্ট। মেজাজটা কেমন লাগে, তাইলে আমাদের ওতো ঘুরিয়ে ওখানে নিল কেন?

Arusha city streets and architecture

ওয়াল্টারের সাথে পরিচয়: স্থানীয় গাইড

আমাদের মেনু দেখতে বলে, সোহান কথা শেষ করতে গেলো। একটু পর এসে বলে, আজকে তো মেঘ আছে, তাই কিলিমাঞ্জারো দেখা যাবে না। তাই রুম নেই নাই। এখানে লাঞ্চ করে ধারে কাছে ঝর্ণা দেখতে যাবো। খাবার অর্ডার করে, সোহান তাদের বললো, আমরা ছাদে থেকে ঘুরে আসি এর মাঝে তোমরা খাবার তৈরি করতে থাকো। তারা জানালো ছাদেই খাবার সার্ভ করবে। শুনে আমরা খুশি মনে ছাদে চলে গেলাম। চারদিকে সবুজ গ্রাম দেখা যায় ঠিক আমাদের গ্রামগুলোর মতো। চারপাশে বেড়া দেওয়া কুড়ে ঘর আর টিনের ঘর। ঘরের সামনে সুন্দর করে বাগান করেছে। বাহারি রঙের ফুল সেখানে। সোহান আকাশের দিকে আঙুল দিয়ে বলল, মেঘ না থাকলে এখানে দেখা যেত কিলিমাঞ্জারো।

ছাদে এসে আলোতে আমার তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। মাথাব্যথা টের পাচ্ছিলাম। টেবিলে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করেছিলাম। আর মেয়েরা মোবাইল গুঁতানো শুরু করলো। সব দেখে সোহানের অতিশয় অভিমান হলো, আমি এত কষ্ট করে তোমাদের ড্রাইভ করে নিয়ে আসলাম, আর তোমরা মোবাইল দেখছো। কিছুক্ষণ বাবা মেয়েদের অভিমান পর্ব চললো। বাবার মান ভাঙানোর জন্য তারা অনেকগুলো ছবি তোলার জন্য পোজ দিল। যাইহোক আমিও বুঝতে পারলাম, বেড়াতে এসে মাথাব্যথা নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। ঝিকে মেরে সোহান বউকে শেখাতে চাচ্ছে।

তানজানিয়ার বৈচিত্র্য

তানজানিয়া খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে মুসলিম প্রেসিডেন্ট এবং মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছে, যা দেশটির ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয়। দেশটিতে ১২০টিরও বেশি উপজাতি বসবাস করে যারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকে।

এদিকে খাবার আর দিয়ে যায় না, সোহান একবার নিচে গিয়ে তাড়া দিয়ে আসলো। এর মাঝে দুজন লোক আসলো, সোহান হোটেল থেকে একজনকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে গাইড হিসাবে, সে ব্যাপারেই তারা কথা বলে গেলো। কিছুক্ষন পর দুই বাটি স্যুপ নিয়ে আসলো, দেখতে ডালের মতো। ক্ষুদায় সোহান, সেবন্তি সেটাই মজা করে খাচ্ছে। এর মাঝে মেইন খাবার চলে আসলো। ফ্রুটস সালাদ দিয়ে গেল। ওদের ফ্রুটস সালাড হলো সব ফল বড় বড় কেটে একটা প্লেটে দেওয়া। ফল খেতে ভালো লাগছিল। তরমুজ, আম, আনারস আর কলা ছিল। তরমুজটা মিষ্টি দেখে সোহান ওয়েটারকে বললো, সে এরকমই একটা তরমুজ নিয়ে যেতে চায়। ব্যাটা বুঝতে পারার ভাব ধরে চলে গেলো। সোহান বললো, তোমরা গুছিয়ে নাও সবকিছু, আমি নিচে গিয়ে বিল দিয়ে আসি। সোহান নিচে যাওয়ার সময় দেখে, সেই ওয়েটার একবাটি তরমুজ নিয়ে উপরে উঠছে। ভাষা বিভ্রাটে তার মনে হয়েছে, আমরা এখনি আরো তরমুজ খেতে চাই, তাই তরমুজ কেটে উপরে আসছিল সে। কি আর করা, সোহান তাকে তরমুজ প্যাকেট করে দিতে বললো। সব কিছু শেষ করে আমরা আবার গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম।

ম্যাটেরুনির পথে: বিপদসংকুল যাত্রা

আমাদের সাথে এবার আছে ওয়াল্টার নামে হালকা পাতলা আকারের একজন তানজানিয়ান। সে হোটেল মালিকের ছেলে, ভালো ইংরেজি পারে। আমাদের গাড়ি আবার গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এর মাঝে তার সাথে কথা হচ্ছে। আমরা এখানে নতুন বলে, সবই ভালো লাগে, দেশের সাথে মিল পেলে আরো বেশি ভালো লাগে। তানজানিয়ার রাস্তায় লোকজন দেখলে নিজের দেশের মানুষের কথা মনে হয়। ওয়াল্টারকে নিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন নানারকম কথাবার্তা চলছিল। ওয়াল্টার কেনিয়াতে পড়াশোনা করেছে একাউন্টিংয়ে। সে প্রথমে আমাদের ইন্ডিয়ান ভেবেছিল। সে কিছু কিছু হিন্দি শব্দ জানে। কথায় কথায় সোহান বললো, তোমাদের এখানে অনেক মুসলিম দেখা যায়। ওয়াল্টার জানালো আমরা সহবস্থানে বিশ্বাসী। ধর্ম কোন বড় বিষয় নয়। জানিয়ে রাখি তানজানিয়া খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং তাদের প্রেসিডেন্ট একজন মুসলিম এবং মহিলা। আমরা চার্চ পেরিয়ে আবার পাকা রাস্তায় উঠলাম। ইট পাথর, বিল্ডিং দেখে বড় হওয়া আমরা মাঠ দেখে মুগ্ধ হই, গাছ দেখে মুগ্ধ হই, গাছের পাতার সবুজ দেখে ভাবি, আল্লাহর কাছে কতরকমের সবুজের শেড আছে!! তানজানিয়া অনেক বেশি সবুজ একটা দেশ।

Arusha city streets and architecture

অনেকখানি ঢালু রাস্তা পেরিয়ে খোলা একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামলো। আমরা পাহাড়ি রাস্তায় চলছি। আসলে এটা পাহাড়ী রাস্তা হবে না পর্বতী রাস্তা হবে। চারদিকে পর্বত দিয়ে ঘেরা খোলা জায়গায় এসে দেখি, সামনে কোন রাস্তা দেখা যায় না। বিভিন্ন দিক থেকে চার পাঁচজন লোক আসছে, ওয়াল্টার তাদের সাথে কথা বলে যাচ্ছে, ভাষা বুঝি না। ওদের সাইজ, কথা বলার স্টাইল দেখলে ভয় লাগতে থাকে; মনে হতে থাকে, এক্ষুনি কোন ভয়ংকর ঘটনা বুঝি ঘটে যাবে। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা চমৎকার মানুষ হিসাবেই প্রমানিত হয়। রাস্তার কাজ চলছে এখানে তাই রাস্তা বন্ধ। পায়ে হেঁটে পার হওয়ার মতো একটা কাঠের ব্রিজ আছে। ব্রিজ পার হলে ওই পাড়ে আবার রাস্তা আছে। ওয়াল্টার ওদের সাথে কি কি কথা বলে সোহানকে গাড়ি ঘুরাতে বললো। আমরা ওখান থেকে চলে এসে নতুন রাস্তা ধরলাম। অনেকখানি যাওয়ার পর একজন মোটর সাইকেল চালক আমাদের সাথে যোগ হলো, সে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিবে।

ম্যাটেরুনি ঝর্ণা: অদেখা সৌন্দর্য

মোটরসাইকেল সামনে সামনে যাচ্ছে আমরা পেছন পেছন। আমার একটু একটু ভয় লাগছিল, অনেক বেলা হয়ে গেছে, আমরা এখনো গন্তব্যের ধারে কাছেও যাই নাই। আমাদেরকে আবার আরুশা শহরে ফেরত যেতে হবে। মোটর সাইকেলওয়ালা আমাদের কাঠের ব্রিজের ওই পাড়ে নিয়ে গেল প্রায় ২০ মিনিটের ড্রাইভের পর। তাকে ২০০০ শিলিং দেওয়া হলো। আবার পাকা রাস্তা মানে কিছুটা ভালো রাস্তা দিয়ে চলা শুরু করলাম। সোহান বারবার বলছিল, ৫ টার দিকে আবহাওয়া ভালো হয়ে গেলে কিলিমাঞ্জেরোর চূড়া দেখা যেতে পারে। কিলিমাঞ্জেরো শুধু মাত্র ভাগ্য ভালো হলেই নাকি দেখা দেয়। রাস্তার বাঁকগুলো এত খাড়া, আমার আসলে আবার ভয় লাগা শুরু হয়েছে। গাড়িতে লাগানো রয়েছে স্পেয়ার চাকা। কোন গর্তে গিয়ে যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে ফিরবো কিভাবে?? একে তো মাথাব্যথা, দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে আর আমরা এখনো গন্তব্যের কাছাকাছি পৌছাতে পারি নাই, আমার খুবই হযবরল লাগছিল। একজন বিদেশি আমাদের গাড়িতে বসা, তার সামনে আমি সোহানকে কিছু বলতে পারছি্লাম না। তাও কয়েকবার বলে ফেলেছি, 'তুমি কি সাহস বেশি দেখাইয়া ফেলতেছ না?'

ম্যাটেরুনি ঝর্ণা সম্পর্কে

ম্যাটেরুনি ঝর্ণা তানজানিয়ার একটি সুন্দর জলপ্রপাত যা ম্যাটেরুনি গ্রামে অবস্থিত। এটি মওয়ারি ঝর্ণা নামেও পরিচিত। এই ঝর্ণাটি কিলিমাঞ্জারোর পাদদেশে অবস্থিত এবং আশেপাশের এলাকায় কফি চাষের জন্য বিখ্যাত। স্থানীয় সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য এখানে প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

নানা বাঁক, নানারকম পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ম্যটেরুনি ঝর্নার টিকেট কাউন্টারে চলে আসলাম। আফ্রিকায় গাছপালার বৈচিত্র‍্য অনেক বেশি। কিছু কিছু স্পটে গাছ, পর্বত আর আকাশ মিলিয়ে এমন একটা দৃশ্য সামনে আসে, মনে হয় জলরংয়ে আঁকা ছবি। ম্যাটেরুনি গ্রামের নামে ঝর্ণার নাম হয়েছে। এর আরও একটা নাম আছে। আরেকটা নাম হলো মওয়ারি, মওয়ারি নদীর ঝর্ণা বলে এই নাম। তানজানিয়া কফির জন্য বিখ্যাত। বেশিরভাগ পাহাড়ী গ্রামগুলোতে কফির চাষ হয়। ম্যাটেরুনি গ্রামেও কফির চাষ হয়। এই গ্রামে টুরিস্টরা ঝর্ণা ছাড়াও কফি চাষ, গাছ থেকে কিভাবে কফি প্রসেস করা হয়, এই সবকিছুও দেখতে আসে। গ্রামের উন্নয়নের জন্য এই গ্রামে প্রবেশের একটা এন্ট্রি ফি নির্ধারন করা হয়েছে সরকার থেকে। এছাড়া টুরিস্টদেরকে গ্রামের একজনকে গাইড হিসাবে বাধ্যতামূলক নিতে হবে। চারজনের টিকেট কাটতে ৩০,০০০ শিলিং লাগলো। আমাদের সাথে একজন গাইড দেওয়া হলো, সে মোটর সাইকেল চালিয়ে আগে আগে যাবে আমরা তাকে অনুসরণ করবো। তাকে ১০,০০০ শিলিং দেওয়া লাগবে।

হাইকিং অভিযান: শিশুদের সাথে চ্যালেঞ্জ

লাল এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তায়, মোটর সাইকেল খুব স্বচ্ছেন্দে যেতে পারলেও, আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হচ্ছিল। গাড়ি আটকে যাওয়ার টেনশন, বিকেলের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার আগে এখান থেকে ফিরে যাওয়ার টেনশন, সাথে মাথাব্যথা মিলিয়ে আমার অবস্থা খুবই করুণ। ওয়াল্টার না থাকলে সোহানের সাথে ধুন্ধুমার কথার কাটাকাটি লেগে যেত। তারও অবশ্য দোষ নাই, গুগল মামা দেখিয়েছে ১ ঘন্টা লাগবে যেতে!! সেখানে কত ঘন্টা যে পার হয়ে গেল, গন্তব্যের দেখা নাই!

তীক্ষ্ণ ঢালু একটা বাঁকের মাথায় আসলাম, ৩০ ডিগ্রি কোনের মতো বাঁকটা; গাড়িটা যেখানে টার্ন নিবে সেখানের রাস্তাটার অবস্থা খুব খারাপ। এখানে আর গাড়ি নেওয়া যাবে না, সোহান পাশেই খোলা জায়গায় গাড়ি সাইড করে রাখলো। বয়স্ক মতো একটা লোক, হাতে একটা বোতল, আমার কাছে দেখে মনে হচ্ছে টাল হয়ে রইছে। আমাদের গাইডরা তার সাথে কথা বলে ঠিক করলো সে গাড়ি দেখে রাখবে, বিনিময়ে পয়সা দিতে হবে। সে গাড়ি ধুয়েও রাখতে চায়, তার অবস্থা দেখে, আমি বলছি, লাগবে না। দেখে রাখলেই হবে। হেঁটে যাওয়ার সিদ্বান্তে আমি খুশি, কারণ গাড়ি কোথাও আটকে যাওয়ার টেনশন তো রইলো না।

"সেই ঢাল বেয়ে নামার সময় একবার পূর্ণ চোখে সামনের দিকে তাকালাম, দুই পর্বতের মাঝখানটা সবুজ গাছপালায় পরিপূর্ণ, বিকালের আলোয় মাখামাখি, তার উপরে আকাশ; সোহান সেই আকাশে কিলিমাঞ্জেরোর চূড়া খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখানে দাঁড়ালে আপনার একটা হৃদস্পন্দন মিস হবেই, মুখ দিয়ে বের হবে, 'সুবহান আল্লাহ'।"

সেই ঢাল বেয়ে নামার সময় একবার পূর্ণ চোখে সামনের দিকে তাকালাম, দুই পর্বতের মাঝখানটা সবুজ গাছপালায় পরিপূর্ণ, বিকালের আলোয় মাখামাখি, তার উপরে আকাশ; সোহান সেই আকাশে কিলিমাঞ্জেরোর চূড়া খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখানে দাঁড়ালে আপনার একটা হৃদস্পন্দন মিস হবেই, মুখ দিয়ে বের হবে, 'সুবহান আল্লাহ'। কিলিমাঞ্জারোর পাদদেশে যাচ্ছি আমরা। মাঝে মাঝে আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না, নবম দশম শ্রেনিতে পড়া ভূগোল বইয়ের 'কিলিমাঞ্জারো' শব্দ চোখের সামনে ভাসে, আমার মেয়েদের নিশ্চয়ই এমন হবে না, তারা কিলিমাঞ্জারোকেই দেখতে পাবে, যখন তারা আফ্রিকা নিয়ে পড়তে বসবে। এখান থেকে ১ কিমি মতো রাস্তা আমাদের নিচে নামতে হবে, গাইডদের কথা মতো ১৫ মিনিটের মতো লাগবে। দুটো বাচ্চা নিয়ে এরকম রাস্তা হেঁটে যাওয়া সহজ কোন ব্যাপার নয়। তাও রক্ষা ছোট মেয়ে যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে দৌড়াতে থাকে, বড় মেয়ে তেমন নয়। তার হাঁটতে কষ্ট লাগে, এমন ঢাল বেয়ে নামতে ভয় লাগে। এর মাঝে সে একবার পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে; এখন সে হাত ধরে হাঁটবে, একটু খারাপ রাস্তা হলেই, সে তার পুরো শরীরের ভর গায়ের উপর দিয়ে দিচ্ছে। একবার মায়ের সাথে, একবার বাবার হাত ধরে হাঁটছে।

Arusha city streets and architecture

অধরা সৌন্দর্য: কাছ থেকে দেখা হয়নি

হাঁটার সময় আমরা ঝিরির শব্দ পাচ্ছিলাম, ঝিরির শব্দ শুনে মনে হচ্ছে আর বেশি দূর হাঁটতে হবে না। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে ঝিরির শব্দ হারিয়ে গেল, তাও ঝর্ণার দেখা নাই। রাস্তার পাশে ছনের ছাউনি দেওয়া দোকান দেখেছি কয়েকটা। দোতলা কাঠের একটা বাজারও পেয়েছি, যদিও সেটা বন্ধ ছিল। দুজন/ তিনজন গ্রামের মহিলারা হেঁটে যায়, তারা আমাদের গাইডের সাথে গল্প করে। আমাদের দেখে হাসি বিনিময় করে। ইউরোপীয় একটা গ্রুপ দেখলাম তারা ফিরে যাচ্ছে। ছোট ছোট তিনটা চারটা তানজানিয়ান বাচ্চা আমাদের সাথে হাঁটছে। অবন্তির কোন দ্বিধা নাই, সে সাবলীলভাবে ওয়াল্টারের সাথে সাথে অনেক খানি এগিয়ে যায়। স্থানীয় গাইড নানারকম গাছ দেখাচ্ছে। ঢালে লম্বা লম্বা ক্রিসমাস ট্রি। এর পাতার গন্ধে নাকি সব ধরনের ভাইরাল ফ্লু দূর হয়ে যায়। একটা গাছের পাতা দেখালো হাড়ি-পাতিল মাজে। হঠাৎ সে দৌড়ে সামনে গিয়ে একটা গাছের ডাল ভেঙে আনলো। গাছের ডালে একটা ক্যামেলিয়ন পাতার রঙের সাথে মিশে ছিল। রূপাঞ্জেলের বন্ধু ক্যামেলিয়ন প্রথমবার সামনাসামনি দেখে মেয়েরা খুব মজা পেল। অবশ্য তাদের বাবা আরো বেশি মজা পেয়েছে। ছবি তোলার সময় ভাঙা ডালের উপর সে চুপটি করে বসেছিল, কোন নড়াচড়া করে নাই। ছবি তোলা শেষ করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। সে গাছের ডালে আরও বড় একটা ক্যামেলিয়ন দেখালো আমাদের।

Arusha city streets and architecture

ক্যামেলিয়ন সম্পর্কে

ক্যামেলিয়ন একটি বিশেষ ধরনের সরীসৃপ যা তার চারপাশের পরিবেশের সাথে শরীরের রং পরিবর্তন করতে পারে। এটি শিকার ধরতে এবং শিকারী থেকে রক্ষা পেতে এই ক্ষমতা ব্যবহার করে। তানজানিয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির ক্যামেলিয়ন পাওয়া যায়।

সেবন্তির জন্য আমাদের গতি অনেক ধীর হয়ে যাচ্ছিল। সোহান, অবন্তি আর স্থানীয় গাইডকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে, ওয়াল্টার আমাদের সাথে হাঁটা শুরু করলো। ওয়াল্টারকে দেখে সেবন্তি প্যানপ্যান না করে লক্ষী বাচ্চার মতো হাঁটছিল। যদিও সে আমাকে মাঝে মাঝেই জানান দিচ্ছিল তার পায়ে ব্যথা, তার কষ্ট হচ্ছে। নীচের থেকে ঝিরির শব্দ আসছিল, ধীরে আমরা ভেজা মাটির রাস্তায় চলে আসলাম, তার মানে গন্তব্য বেশি দূর না। আরও অনেকখানি হাঁটার পর সোহান, অবন্তিকে দেখতে পেলাম।

Arusha city streets and architecture
"ঝিরি এখানে অনেক খানি চওড়া। ছোট বড় নানা আকারের পাথরের মাঝে ছুটে চলা পানির শব্দ আলাদা রিদম তৈরি করছে। এখান থেকে ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে। আমি এত সুন্দর ঝিরি নদী কখনো দেখি নাই। এই সৌন্দর্যে মানুষের কোন স্পর্শ নাই। আর এই রূপ ঠিক বর্ননাও করা যায় না।"

ঝিরি এখানে অনেক খানি চওড়া। ছোট বড় নানা আকারের পাথরের মাঝে ছুটে চলা পানির শব্দ আলাদা রিদম তৈরি করছে। এখান থেকে ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে। আমি এত সুন্দর ঝিরি নদী কখনো দেখি নাই। এই সৌন্দর্যে মানুষের কোন স্পর্শ নাই। আর এই রূপ ঠিক বর্ননাও করা যায় না। ক্যামেরার ছবি দেখে মনে হয়, ছবিতে তো কিছুই আসছে না। স্থানীয় গাইড বললো আরো পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে তাহলে আমরা ঝর্ণার নিচে পৌঁছাতে পারব। এতক্ষণ ওয়াল্টারের সামনে সেবন্তি কিছু বলতে পারে নাই, এখন বাবা কাছে আছে, সে শুরু করলো কান্না, সে কিছুতেই আর হাঁটবে না। সোহান আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে, যেন আমি কিছু বলি। দু'জন বিদেশি মানুষের সামনে বাচ্চাকে তো বকা দেওয়া যায় না; আদর করেই বোঝানোর চেষ্টা করলাম, সে তো বোঝে না। আমার মাথাব্যথায় চোখ-মুখ ফুলে গেছে, আমি বেশি চিন্তাও করতে পারছিলাম না। সোহান বললো আমি যাই তোমরা থাকো। মেয়ে আবার চিৎকার, "না বাবা, না বাবা" মানে বাবাকেও যেতে দিবে না। আমাদের হাতে সময় ছিল না যে এখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার এগুবো। তাই ফিরে যাওয়ায় ঠিক মনে হলো। ফিরে যাওয়ার সময় বারবার পিছন ফিরে দেখছিলাম, এত সুন্দর ঝর্না, কাছ থেকে দেখা হল না!! সোহান বললো, মনখারাপ করো না, আবার আসবো। আমিও ভাবছি আসবো, কিন্তু সত্যিই আসতে পারবো কিনা জানি না।

ফেরার পথ: স্মৃতিতে ধরা অপূর্ণ স্বপ্ন

ফেরার পথে সোহান অনেক তাড়া দিচ্ছিল, কারণ অন্ধকার হয়ে আসছে, আমাদের অনেক খানি পথ হেঁটে যেতে হবে। সেবন্তিকে টেনে, ঠেলে নানাভাবে সামনে আগানো হচ্ছে। সেবন্তির অনেক পানির পিপাসা পেয়েছে, আমাদের সাথে আনা পানি শেষ, তাই আমরা সবাই গ্রামের একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। সোহান পানি কিনতে কিনতে, স্থানীয় গাইড কোথা থেকে যেন অনেকগুলো ফুল এনে, আমাদের তিনজনকে দিল। অবন্তি অনেক চিন্তায় পড়ে গেল,

Arusha city streets and architecture

--মা এই ফুল তো আমরা বাসায় নিতে পারবো না।

আমি বললাম, কেন?

সে বলে, 'ফুল দেখলে তো বী মানে মৌমাছি চলে আসবে বাসায়।' সে আবার যেকোন পোকা অনেক ভয় পায়।

আমি বলি, 'আসবে না, দরজা জানালা লাগিয়ে রাখবো।'

সে মাথা নেড়ে বললো, 'না বী আসবে ফুল বাসায় নেওয়া যাবে না।'

আমি বললাম, 'তুমি একথা বলো না, সে তোমাকে ফুল দিয়েছে; তুমি ফেলে দিলে তার মনখারাপ হবে। আমি দেখছি ফুল নিয়ে কি করা যায়।'

সে বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেলো। দুজন গ্রামের মহিলা ওয়াল্টারের সাথে হাসি মুখে কি যেন বলতে বলতে চলে গেল। ওয়াল্টার বললো, তোমার মেয়েকে মানে সেবন্তিকে ওরা বহন কিরে নিয়ে যেতে চায়। আমি বললাম তাহলে তো খুব ভালো হয়।, আমার মেয়ের অবস্থা দেখে মজা করছিল তারা। আমরা শেষ ঢাল বেয়ে উপরে উঠছি, এরপরই গাড়ির কাছে পৌঁছে যাব। একজন বুড়ো মতো মহিলা নামছে, সে হাসি মুখে ইংরেজিতে বলছে, 'তোমার ছোট মেয়ে আমকে দিয়ে দাও।' আমি জানি সে মজা করে বলছে কিন্তু আমার খট করে বুকের মাঝে লাগলো। আমি সিরিয়াসলি না না করে উঠলাম। সে হাসতে হাসতে চলে গেল। গাড়ির কাছে চলে এসেছি, হাঁটা শেষ।

Arusha city streets and architecture

হাইকিং করে ঝর্ণা দেখতে যাওয়া সহজ কোন কাজ না। আমাদের জন্য এই প্রথম, এভাবে ঝর্ণা দেখতে যাওয়া। গাড়ি খুব সুন্দর করে পরিস্কার করে রেখেছে সেই টাল হওয়া লোকটা। তাকে পয়সা দিয়ে, আমরা আবার রওনা হলাম। স্থানীয় গাইড আমাদের সেই কাঠের ব্রিজ পর্যন্ত নিয়ে গেল। তারপর তাকেও বিদায় দিয়ে, আমরা শহরে আসলাম সন্ধ্যা নাগাদ। সোহান বললো কফি না খেলে গাড়ি চালাতে পারবে না সে। তাছাড়া নামাজও পড়তে হবে। ওয়াল্টার বললো, 'তোমাকে মোসি শহরের সব থেকে ভালো কফির শপে নিয়ে যাব?' সোহান বললো, 'সব থেকে ভালো লাগবে না, কফি হলেই হবে।' একসাথে কফি শেষ করে ওয়াল্টার বিদায় নিল। ওয়াল্টারকে আমাদের কাছে চমৎকার মানুষ মনে হয়েছে।

"স্ট্রিট লাইট ছাড়া রোডে আমরা আরুশার পথ ধরলাম। আকাশে সন্ধ্যা তারা ফুটেছে। বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির আলোয় বোঝা যাচ্ছে, দিগন্তে মিলিয়া যাওয়া আলোর মিছিলটাই আমাদের বাড়ি ফেরার রাস্তা। হঠাৎ খেয়াল হল, ম্যাটেরুনির সামনে গিয়ে ভুলে যাওয়া মাথা ব্যথাটা আবার জেগে উঠেছে! হালকা করে চোখ বুজলাম, চোখের সামনে ঝিরিটা চলে এলো, কানে ঝর্নার পানির গর্জন। আর দূর থেকে দেখা অদ্ভুত সুন্দর ঝর্ণা, সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে রইলো।"

স্ট্রিট লাইট ছাড়া রোডে আমরা আরুশার পথ ধরলাম। আকাশে সন্ধ্যা তারা ফুটেছে। বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির আলোয় বোঝা যাচ্ছে, দিগন্তে মিলিয়া যাওয়া আলোর মিছিলটাই আমাদের বাড়ি ফেরার রাস্তা। হঠাৎ খেয়াল হল, ম্যাটেরুনির সামনে গিয়ে ভুলে যাওয়া মাথা ব্যথাটা আবার জেগে উঠেছে! হালকা করে চোখ বুজলাম, চোখের সামনে ঝিরিটা চলে এলো, কানে ঝর্নার পানির গর্জন। আর দূর থেকে দেখা অদ্ভুত সুন্দর ঝর্ণা, সারাজীবনের স্মৃতি হয়ে রইলো।

ম্যাটেরুনি ঝর্ণা ভ্রমণ টিপস:

Scroll to Top